প্রতিদিন কত লিটার পানি খাওয়া উচিত
বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ, চারদিকে জল-নদী থাকলেও আশ্চর্যের বিষয় হলো – আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সবচেয়ে বড় অবহেলা হয় পানি খাওয়ার ক্ষেত্রে। অনেকেই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে ফেলেন, কিন্তু এক গ্লাস পানি খেতে ভুলে যান। অথচ পানি আমাদের শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শুধু খাবার খেলে শরীর টিকবে না, সেই খাবার হজম করতেও পানির প্রয়োজন। আমাদের রক্ত, মস্তিষ্ক, হাড়, ত্বক—সবকিছুতেই পানি মৌলিক উপাদান হিসেবে কাজ করে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলেন, একজন মানুষের শরীরের গড়ে ৬০–৭০ শতাংশ অংশ পানি দ্বারা গঠিত। রক্ত সঞ্চালন, কোষের ভেতর পুষ্টি সরবরাহ, বর্জ্য পদার্থ বের করে দেওয়া, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, এমনকি চিন্তা-ভাবনা ও মনোযোগ ধরে রাখা—সব কিছুর সাথেই পানির গভীর সম্পর্ক আছে। এজন্য প্রতিদিন কত লিটার পানি খাওয়া উচিত, সেটি জানা প্রত্যেকের জন্য জরুরি।
আমাদের দেশের আবহাওয়া গরম ও আর্দ্র। গ্রীষ্মে তীব্র গরমে প্রচুর ঘাম হয়, বর্ষায় স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া শরীরকে ভারী করে তোলে, আর শীতে তৃষ্ণা কম লাগলেও দেহের ভেতরে পানির ঘাটতি চলতেই থাকে। তাই শুধু পিপাসা অনুভব করলেই পানি খাওয়ার অভ্যাস যথেষ্ট নয়; সচেতনভাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি খাওয়া জরুরি।
কৃষক, শ্রমিক, গার্মেন্টস কর্মী বা যারা দিনভর মাঠে ও কারখানায় কঠোর পরিশ্রম করেন—তাদের পানির চাহিদা অফিসে বসে কাজ করা মানুষের তুলনায় অনেক বেশি। আবার যাদের পেশা খেলাধুলার সাথে জড়িত, যেমন ফুটবল বা ক্রিকেট খেলোয়াড়, তাদের শরীর থেকে ঘামের মাধ্যমে অনেক লিটার পানি বেরিয়ে যায়। তাই তারা যদি পর্যাপ্ত পানি না পান করেন, তাহলে সহজেই ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতায় ভুগবেন।
গর্ভবতী নারী ও স্তন্যদানকারী মায়েদের শরীরে পানির চাহিদা দ্বিগুণ হয়ে যায়। তাদের শরীরে নতুন প্রাণ গড়ে উঠছে, শিশুর জন্য দুধ তৈরি হচ্ছে—সবকিছুর জন্য পর্যাপ্ত পানি অপরিহার্য। অনেক মা-ই দিনে যথেষ্ট পানি খেতে পারেন না, ফলে দুর্বলতা, মাথা ঘোরা বা কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগেন। অথচ যদি নিয়মিত সঠিক পরিমাণ পানি খাওয়ার অভ্যাস তৈরি করা যায়, তাহলে এসব সমস্যার অনেকটাই এড়ানো সম্ভব।
বাংলাদেশের খাবার সংস্কৃতিতেও পানির গুরুত্ব রয়েছে। ভাত, তরকারি, ডাল, মাছ, মাংস—এসব খাবারের সাথে পানি ছাড়া একদিনও কল্পনা করা যায় না। তবে খাবারের সাথে পানি পান করার ধরন নিয়েও রয়েছে নানা ভুল ধারণা। কেউ কেউ খাওয়ার সময় একেবারেই পানি খান না, আবার কেউ খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকটা পানি খেয়ে ফেলেন। চিকিৎসকরা বলছেন—পানি খাওয়ার সময়ের ওপরও শরীরের স্বাস্থ্যের প্রভাব পড়ে।
শুধু শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য নয়, মানসিক সুস্থতার ক্ষেত্রেও পানি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অনেক সময় হঠাৎ মনোযোগে ঘাটতি, ক্লান্তি বা মাথাব্যথার মূল কারণ হলো পানিশূন্যতা। অথচ আমরা ভাবি হয়তো ঘুম কম হয়েছে বা খাবার খাইনি। বাস্তবে দেখা যায়, এক গ্লাস পানি খাওয়ার পরই সেই সমস্যার অনেকটা সমাধান হয়ে যায়।
অন্যদিকে, আধুনিক জীবনে চা, কফি, কোমল পানীয় বা এনার্জি ড্রিংকের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে গেছে। এগুলো সাময়িকভাবে সতেজতা দিলেও আসলে শরীরকে আরও বেশি পানিশূন্য করে। তাই আসল সমাধান হলো পরিষ্কার বিশুদ্ধ পানি—যেটির কোনো বিকল্প নেই।
এখন প্রশ্ন হলো, আসলে প্রতিদিন কত লিটার পানি খাওয়া উচিত? অনেকেই বলেন “৮ গ্লাস পানি” যথেষ্ট, কেউ বলেন ২ লিটার, আবার কেউ বলেন ওজন অনুযায়ী হিসাব করতে হবে। বাস্তবে বিষয়টি নির্ভর করে বয়স, ওজন, কাজের ধরণ, আবহাওয়া ও ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যের ওপর। তবে সঠিক তথ্য জানা থাকলে প্রত্যেকে নিজের জন্য সঠিক পরিমাণ নির্ধারণ করতে পারবেন।
প্রতিদিন কত লিটার পানি খাওয়া উচিত?

শরীরের প্রতিটি কার্যক্রম সঠিকভাবে চালাতে হলে প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি খাওয়া অপরিহার্য। সাধারণভাবে বলা হয়, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দিনে অন্তত ২–৩ লিটার পানি পান করা উচিত। তবে বিষয়টি সবার জন্য সমান নয়। বয়স, ওজন, আবহাওয়া, কাজের ধরন এবং স্বাস্থ্য পরিস্থিতি অনুযায়ী পানি খাওয়ার পরিমাণ কমবেশি হতে পারে। তাই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে প্রতিটি দিক বিবেচনা করা জরুরি। নিচে আলাদা আলাদা উপশিরোনামে বিস্তারিত আলোচনা দেওয়া হলো।
১. বয়সভিত্তিক পানি গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা
শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবার পানি খাওয়ার চাহিদা আলাদা। শিশুদের দেহ ছোট হলেও তাদের মেটাবলিজম দ্রুত হয়, ফলে তারা ঘন ঘন পানি বা তরল চায়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের ক্ষেত্রে দিনে অন্তত ১.৫ লিটার পানি দরকার। কিশোরদের ক্ষেত্রে প্রয়োজন ২ লিটার বা তার বেশি, বিশেষ করে যারা খেলাধুলা করে। তরুণ বা মধ্যবয়সী মানুষদের জন্য প্রতিদিন ২.৫–৩ লিটার পানি যথেষ্ট। অন্যদিকে বৃদ্ধদের তৃষ্ণা কম লাগে, ফলে অনেক সময় পানি কম খেয়ে ফেলেন, এতে ডিহাইড্রেশন হয়ে শরীর দুর্বল হয়। তাই বয়স বাড়ার সাথে সাথে সচেতনভাবে পানি খাওয়ার অভ্যাস জরুরি। বাংলাদেশে দেখা যায়, অনেক বৃদ্ধ নিয়মিত পানি খেতে ভুলে যান, ফলে প্রস্রাবের সমস্যা, কোষ্ঠকাঠিন্য বা মাথা ঘোরা বাড়ে।
২. আবহাওয়ার প্রভাব (গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত)
বাংলাদেশের গ্রীষ্মকাল গরম ও আর্দ্র। তখন প্রচুর ঘাম হয়, আর ঘামের মাধ্যমে শরীর থেকে লবণ-পানি বেরিয়ে যায়। তাই গ্রীষ্মে অন্তত ৩–৩.৫ লিটার পানি খাওয়া উচিত। বর্ষায় আর্দ্রতার কারণে ঘাম বোঝা না গেলেও শরীর থেকে পানি বের হয়, তাই ২.৫–৩ লিটার দরকার। শীতে মানুষ কম তৃষ্ণা অনুভব করে, কিন্তু দেহের ভেতরে তখনও পানি ব্যয় হয়—শ্বাস-প্রশ্বাস, প্রস্রাব এবং হজম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। শীতে অন্তত ২–২.৫ লিটার পানি খাওয়া প্রয়োজন। আমাদের দেশে শীতকালে অনেকেই পানি খাওয়ার অভ্যাস হারিয়ে ফেলেন, যা শরীরে পানিশূন্যতা তৈরি করে। তাই আবহাওয়ার তারতম্য অনুযায়ী পানির পরিমাণ ঠিক করতে হবে।
৩. ওজন ও উচ্চতার ওপর ভিত্তি করে হিসাব
চিকিৎসকরা সাধারণভাবে বলেন—প্রতিদিন শরীরের প্রতি কেজি ওজনের জন্য ৩০–৩৫ মিলিলিটার পানি খাওয়া উচিত। যেমন, ৬০ কেজি ওজন হলে দিনে ১.৮–২.১ লিটার পানি প্রয়োজন। যদি কারও ওজন ৮০ কেজি হয়, তবে তার দরকার প্রায় ২.৪–২.৮ লিটার পানি। বাংলাদেশে অনেকেই অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতায় ভোগেন, তাদের শরীরে মেটাবলিজম ধীর হলেও পানির প্রয়োজন কমে যায় না। আবার যারা খুবই পাতলা বা আন্ডারওয়েট, তাদেরও শরীর সচল রাখতে নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি খাওয়া আবশ্যক। প্রতিদিন কত লিটার পানি খাওয়া উচিত—এই প্রশ্নের অন্যতম সহজ উত্তর হলো ওজন অনুযায়ী হিসাব করা।
৪. শারীরিক পরিশ্রম ও কাজের ধরন
একজন অফিসকর্মী সারা দিন এয়ারকন্ডিশনে বসে কাজ করেন, আরেকজন কৃষক মাঠে রোদে কাজ করেন—দুজনের পানির চাহিদা কখনো এক হবে না। মাঠে যারা পরিশ্রম করেন, তাদের শরীর থেকে প্রচুর ঘাম ঝরে, ফলে দিনে ৩.৫–৪ লিটার পানি লাগতে পারে। নির্মাণশ্রমিক, গার্মেন্টস কর্মী বা পরিবহন চালকরাও প্রচুর পানি খাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেন। অন্যদিকে, অফিসকর্মীরা দিনে অন্তত ২–২.৫ লিটার পান করলে যথেষ্ট হয়। কাজের ধরন যত কষ্টসাধ্য, তত বেশি পানি খাওয়া উচিত। বাংলাদেশে যারা রিকশাচালক বা ভ্যানচালক, তাদের ক্ষেত্রে এই নিয়ম বিশেষভাবে প্রযোজ্য।
৫. গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মায়েদের জন্য
গর্ভাবস্থায় একজন নারীর শরীরে নতুন প্রাণ গড়ে ওঠে। তাই তার শরীরে পানি চাহিদা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। গর্ভাবস্থায় প্রতিদিন অন্তত ৩ লিটার পানি খাওয়া উচিত। এতে ভ্রূণের বৃদ্ধি, প্ল্যাসেন্টার রক্তপ্রবাহ এবং মায়ের শরীরের হরমোন ভারসাম্য বজায় থাকে। একইভাবে স্তন্যদানকারী মায়েদের শরীর থেকে দুধের মাধ্যমে প্রচুর পানি বেরিয়ে যায়। তাই তাদের জন্যও প্রতিদিন ৩–৩.৫ লিটার পানি অপরিহার্য। বাংলাদেশে অনেক মায়ের দুর্বলতা বা মাথা ঘোরা পানির অভাব থেকেই হয়, অথচ তারা তা খেয়াল করেন না।
৬. ক্রীড়াবিদ ও ব্যায়ামকারীদের জন্য
যারা প্রতিদিন জিমে যান বা খেলাধুলায় অংশ নেন, তাদের শরীর থেকে ঘামের মাধ্যমে লিটার লিটার পানি বেরিয়ে যায়। তাই তাদের পানি গ্রহণের পরিমাণ অন্যদের তুলনায় দ্বিগুণ। সাধারণ ব্যায়ামের সময় অন্তত ৫০০–৭০০ মিলিলিটার পানি খাওয়া দরকার। ফুটবল, ক্রিকেট বা দৌড়ের খেলোয়াড়দের দিনে ৩.৫–৪ লিটার পানি খাওয়া প্রয়োজন। এছাড়া ব্যায়ামের আগে ও পরে পর্যাপ্ত পানি না খেলে শরীর দুর্বল হয়ে যায়, মাংসপেশিতে টান ধরে এবং ক্লান্তি দেখা দেয়। তাই প্রতিদিন কত লিটার পানি খাওয়া উচিত—এর ক্ষেত্রে ক্রীড়াবিদদের জন্য উত্তর হবে: অন্তত ৪ লিটার।
৭. অসুস্থ অবস্থায় পানির গুরুত্ব
ডায়রিয়া, বমি, জ্বর বা কিডনির রোগে শরীর থেকে প্রচুর পানি বের হয়ে যায়। ডায়রিয়ার সময় একজন মানুষের দিনে প্রায় ৫ লিটার তরল প্রয়োজন হতে পারে। ওআরএস (ORS) খাওয়ার মাধ্যমে শরীরে পানির ঘাটতি পূরণ করা জরুরি। জ্বরের সময়ও শরীর ঘামের মাধ্যমে অনেকটা পানি হারায়। আবার কিডনির রোগীদের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া পানি কমবেশি করা উচিত নয়। বাংলাদেশে গরমের মৌসুমে ডায়রিয়া ও কলেরার মতো রোগ ব্যাপকভাবে ছড়ায়, তখন সঠিক পরিমাণ পানি খাওয়া না হলে জীবন ঝুঁকির মুখে পড়ে।
৮. খাবার থেকে পাওয়া পানি
আমরা যে ভাত, ডাল, তরকারি, ফলমূল খাই—এসব খাবার থেকেও শরীর প্রচুর পানি পায়। যেমন শসা, তরমুজ, কমলা, টমেটোতে প্রায় ৭০–৯০% পানি থাকে। ভাত রান্নার সময়ও প্রচুর পানি ব্যবহার হয়। তাই প্রতিদিন কত লিটার পানি খাওয়া উচিত—হিসাব করার সময় খাবার থেকে পাওয়া পানিকেও বিবেচনায় নিতে হবে। গরমের দিনে ফলের রস বা ডাবের পানি শরীরের জন্য খুবই উপকারী। তবে কোল্ড ড্রিংক বা অতিরিক্ত মিষ্টি জুস এড়িয়ে চলাই ভালো।
৯. শরীরের সংকেত ও লক্ষণ
শরীর নিজেই বলে দেয় কখন পানি প্রয়োজন। মুখ শুকিয়ে যাওয়া, ঠোঁট ফেটে যাওয়া, প্রস্রাবের রং গাঢ় হয়ে যাওয়া, মাথা ব্যথা বা ক্লান্তি—এসবই ডিহাইড্রেশনের লক্ষণ। বাংলাদেশে অনেকে দীর্ঘ সময় বাইরে কাজ করেন, কিন্তু পানি খাওয়ার অভ্যাস থাকে না। এর ফলে হঠাৎ মাথা ঘোরা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া পর্যন্ত ঘটনা ঘটে। তাই শরীরের সংকেত দেখেই পানি খাওয়া উচিত। মনে রাখবেন, তৃষ্ণা লাগা মানেই শরীরে ইতিমধ্যে পানির ঘাটতি শুরু হয়ে গেছে।
১০. অভ্যাস ও জীবনযাত্রা
সবশেষে আসে ব্যক্তিগত অভ্যাস। অনেকেই পানি খাওয়ার গুরুত্ব বোঝেন, কিন্তু সারাদিনে এক-দুই গ্লাসের বেশি খান না। আবার কেউ কেউ চা বা কফিকে পানি হিসেবে ধরেন, যা আসলে উল্টো শরীরকে পানিশূন্য করে। প্রতিদিন কত লিটার পানি খাওয়া উচিত—তার উত্তর জানা থাকলেও তা অভ্যাসে পরিণত না করলে কোনো লাভ নেই। এজন্য সাথে পানির বোতল রাখা, সকালে ঘুম থেকে উঠে এক গ্লাস পানি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং রাতে ঘুমানোর আগে পর্যাপ্ত পানি খাওয়ার অভ্যাস তৈরি করা জরুরি।
পানির অভাবে কি রোগ হয়?

শরীরের ৬০% এর বেশি অংশ পানি দিয়ে তৈরি। এই পানি প্রতিদিন ঘাম, প্রস্রাব, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বের হয়ে যায়। যদি পর্যাপ্ত পানি না খাওয়া হয়, শরীর দ্রুত পানিশূন্যতায় ভোগে এবং একে একে নানা জটিল রোগ দেখা দেয়। বাংলাদেশে গরম, আর্দ্র আবহাওয়া এবং ব্যস্ত জীবনযাত্রার কারণে অনেকেই অজান্তে এই সমস্যায় আক্রান্ত হন। তাই চলুন বিস্তারিতভাবে জেনে নেই পানির অভাবে কোন কোন রোগ হতে পারে।
১. কিডনি স্টোন বা বৃক্কে পাথর
যখন আমরা পর্যাপ্ত পানি পান করি না, তখন প্রস্রাবে খনিজ পদার্থ যেমন ক্যালসিয়াম, ইউরিক এসিড, অক্সালেট ইত্যাদি জমতে থাকে। স্বাভাবিকভাবে পানি থাকলে এগুলো সহজে গলে প্রস্রাবের সঙ্গে বের হয়ে যায়। কিন্তু পানির ঘাটতি হলে এগুলো স্ফটিক আকারে জমে পাথরে রূপ নেয়। বাংলাদেশে বিশেষ করে গরমকালে এই রোগ বেশি দেখা যায়। কিডনিতে পাথর হলে তীব্র ব্যথা, প্রস্রাব আটকে যাওয়া, প্রস্রাবে রক্ত আসা ইত্যাদি সমস্যা হয়। নিয়মিত প্রতিদিন কত লিটার পানি খাওয়া উচিত সেটা মেনে চললে এই রোগ সহজেই প্রতিরোধ করা যায়।
২. ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (UTI)
নারীদের মধ্যে ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বা প্রস্রাবের সংক্রমণ খুবই সাধারণ। এর অন্যতম কারণ হলো পর্যাপ্ত পানি না খাওয়া। পানি কম খেলে প্রস্রাব ঘন হয়ে যায়, ফলে ব্যাকটেরিয়া সহজে বাড়তে থাকে। এতে জ্বালা, ব্যথা, ঘন ঘন প্রস্রাবের চাপ, এমনকি জ্বরও হতে পারে। অনেক সময় চিকিৎসা না করালে কিডনি পর্যন্ত সংক্রমণ ছড়িয়ে যায়। দিনে পর্যাপ্ত পানি খেলে প্রস্রাব পাতলা থাকে এবং জীবাণু বের হয়ে যায়। এজন্য চিকিৎসকরা বারবার মনে করিয়ে দেন—শরীর সুস্থ রাখতে পরিষ্কার পানি সবচেয়ে বড় ওষুধ।
৩. কোষ্ঠকাঠিন্য
খাবার হজমের জন্য এবং অন্ত্রের ভেতরে খাদ্য নরম রাখতে পানির ভূমিকা অপরিসীম। পানি কম খেলে খাদ্যশস্য শুকিয়ে যায়, ফলে মল শক্ত হয়ে যায়। এতে কোষ্ঠকাঠিন্য তৈরি হয়, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্শ বা পাইলসের ঝুঁকি বাড়ায়। বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় অনেকেই শাকসবজি কম খান এবং পানি খাওয়ার অভ্যাসও ঠিক নেই, ফলে এ রোগ বেশি দেখা যায়। নিয়মিত পর্যাপ্ত পানি খেলে অন্ত্র মসৃণভাবে কাজ করে এবং হজমতন্ত্র ভালো থাকে।
৪. ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা
এটি সবচেয়ে সাধারণ ও দ্রুত দেখা দেওয়া সমস্যা। প্রচণ্ড গরমে, দীর্ঘ সময় কাজ করলে বা ডায়রিয়া হলে শরীর থেকে পানি দ্রুত বেরিয়ে যায়। এর ফলে মাথা ঘোরা, অতিরিক্ত ক্লান্তি, ত্বক শুষ্ক হওয়া, চোখ ডুবে যাওয়া, প্রস্রাব কম হওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়। ছোট শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য এটি বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ তারা সহজেই পানিশূন্য হয়ে যায়। সঠিক সময়ে পানি না খেলে এই অবস্থা জীবনহানিকর হতে পারে।
৫. গ্যাস্ট্রিক ও এসিডিটি
অনেকেই ভেবে থাকেন গ্যাস্ট্রিক শুধু ঝাল বা মশলাদার খাবারের কারণে হয়। বাস্তবে পানি কম খাওয়াও একটি প্রধান কারণ। পাকস্থলীতে এসিড তৈরি হলে পানি সেই এসিডকে পাতলা করে দেয়। কিন্তু পর্যাপ্ত পানি না থাকলে এসিড জমে গিয়ে জ্বালাপোড়া, বুকজ্বালা, ডাকার সমস্যা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, খাবারের আগে বা খাবারের মাঝে অল্প পানি খাওয়া পাকস্থলীর জন্য ভালো।
৬. মাথাব্যথা ও মাইগ্রেন
অনেক সময় মাথাব্যথা বা মাইগ্রেনের আসল কারণ হলো পানিশূন্যতা। যখন মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিক থাকে না, তখন মাথার ভেতরে চাপ তৈরি হয় এবং ব্যথা শুরু হয়। ডিহাইড্রেশনের কারণে স্নায়ু ও রক্তনালীর ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মাথাব্যথা বাড়ে। বাংলাদেশের কর্মব্যস্ত মানুষরা অফিসে কাজের ফাঁকে পানি খেতে ভুলে যান, ফলে বিকেল নাগাদ মাথাব্যথা দেখা দেয়। এক গ্লাস পানি অনেক সময় তাৎক্ষণিক সমাধান এনে দেয়।
৭. ত্বক শুষ্কতা ও অকাল বার্ধক্য
ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখার জন্য ভেতর থেকে পানির প্রয়োজন। শুধু বাহ্যিক ক্রিম বা লোশন ব্যবহার করে ত্বক আর্দ্র রাখা যায় না। পানি কম খেলে ত্বক ফেটে যায়, রুক্ষ হয়ে পড়ে এবং দ্রুত বলিরেখা দেখা দেয়। বিশেষ করে শীতকালে এই সমস্যা বেশি হয়। নিয়মিত পানি খেলে শরীরের ভেতর থেকে ত্বক আর্দ্র থাকে এবং প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতা বজায় থাকে।
৮. নিম্ন রক্তচাপ
রক্তের প্রধান উপাদান হলো পানি। পানি কম হলে রক্তের পরিমাণও কমে যায়। এর ফলে রক্তচাপ হঠাৎ কমে যায়। এতে মাথা ঘোরা, দুর্বলতা, এমনকি অজ্ঞান হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বাংলাদেশের গ্রামে মাঠে কাজ করা কৃষকরা প্রচুর ঘামেন, কিন্তু অনেকেই সময়মতো পানি পান করেন না। এতে শরীরে লবণ ও পানির ঘাটতি হয় এবং রক্তচাপ কমে যায়।
৯. কিডনি বিকল হওয়ার ঝুঁকি
পানি হলো কিডনির প্রাকৃতিক ক্লিনার। পানি কম হলে কিডনি বর্জ্য বের করতে পারে না। দীর্ঘদিন এভাবে চলতে থাকলে কিডনির ওপর চাপ পড়ে এবং ধীরে ধীরে কাজ করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। বাংলাদেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে, যার অন্যতম কারণ নিয়মিত পানি না খাওয়া। চিকিৎসকরা তাই বারবার পরামর্শ দেন—শরীর সুস্থ রাখতে পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে।
১০. হিটস্ট্রোক
গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড রোদে কাজ করার সময় শরীর থেকে প্রচুর ঘাম বের হয়। ঘামের সঙ্গে পানি ও লবণ দুই-ই বেরিয়ে যায়। পর্যাপ্ত পানি না খেলে শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে এবং এক পর্যায়ে হিটস্ট্রোক হয়। এটি জীবনঘাতী সমস্যা। কৃষক, রিকশাচালক, নির্মাণশ্রমিকদের মধ্যে এই ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। নিয়মিত বিরতিতে পানি খাওয়া এবং ওআরএস সেবন করলে এই রোগ প্রতিরোধ করা যায়।
পানি বেশি খেলে কি হয়

আমরা সবাই জানি পানি শরীরের জন্য অত্যন্ত জরুরি। তবে “ভালো জিনিস বেশি খেলেও ক্ষতি হতে পারে”—এই প্রবাদ পানির ক্ষেত্রেও সত্যি। প্রতিদিন কত লিটার পানি খাওয়া উচিত তার একটি নির্দিষ্ট সীমা আছে। সেই সীমার বাইরে গিয়ে অতিরিক্ত পানি খেলে শরীরে পানি জমে নানা সমস্যা তৈরি করে। যেমন—সোডিয়ামের ভারসাম্য নষ্ট হওয়া, কিডনির ওপর চাপ, মস্তিষ্কে পানি জমে যাওয়া ইত্যাদি। তাই পানি কম খাওয়া যেমন ক্ষতিকর, অতিরিক্ত খাওয়াও শরীরের জন্য সমান ঝুঁকিপূর্ণ।
১. হাইপোন্যাট্রেমিয়া (রক্তে সোডিয়াম কমে যাওয়া)
অতিরিক্ত পানি খাওয়ার ফলে শরীরে সোডিয়ামের ঘনত্ব কমে যায়। সোডিয়াম হলো এমন একটি খনিজ যা কোষের ভেতর ও বাইরের তরল ভারসাম্য বজায় রাখে। যখন বেশি পানি পান করা হয়, তখন রক্ত পাতলা হয়ে যায় এবং সোডিয়ামের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়। এটিকে বলা হয় হাইপোন্যাট্রেমিয়া। এর ফলে মাথা ব্যথা, বমি বমি ভাব, বিভ্রান্তি এমনকি খিঁচুনি হতে পারে। বাংলাদেশে গরমকালে অনেকে ভেবে নেন যত বেশি পানি খাবেন তত ভালো, অথচ এটি উল্টো বিপদ ডেকে আনে।
২. কিডনির ওপর অতিরিক্ত চাপ
আমাদের কিডনির প্রধান কাজ হলো শরীর থেকে অতিরিক্ত পানি ও বর্জ্য বের করে দেওয়া। কিন্তু যখন আমরা অতিরিক্ত পানি খাই, তখন কিডনিকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়। প্রতিদিন কত লিটার পানি খাওয়া উচিত, তা না মেনে অনিয়ন্ত্রিতভাবে পানি খেলে কিডনির স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হয়। দীর্ঘদিন ধরে এটি চলতে থাকলে কিডনির কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং কিডনি বিকল হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
৩. ঘন ঘন প্রস্রাবের সমস্যা
অতিরিক্ত পানি খাওয়া মানেই ঘন ঘন টয়লেটে যেতে হবে। এতে শুধু অস্বস্তি নয়, শরীর থেকে প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থও বের হয়ে যায়। বাংলাদেশে অনেকেই কর্মব্যস্ত সময়ে বারবার টয়লেটে যাওয়া এড়াতে কম পানি খাওয়ার অভ্যাস করেন। আবার কেউ কেউ ডায়েট বা ফিটনেসের কারণে হঠাৎ বেশি পানি খাওয়া শুরু করেন। ফলে দিনের কাজের স্বাভাবিক ছন্দ নষ্ট হয় এবং রাতে ঘুমও ব্যাহত হয়।
৪. ঘুমের সমস্যা
যারা রাতে অতিরিক্ত পানি খান, তাদের বারবার ঘুম ভেঙে টয়লেটে যেতে হয়। এর ফলে ঘুম গভীর হয় না এবং শরীর বিশ্রাম পায় না। ঘুমের ব্যাঘাত হলে পরদিন মাথা ব্যথা, ক্লান্তি, মনোযোগের ঘাটতি তৈরি হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের কর্মজীবী মানুষদের জন্য এটি বড় সমস্যা। সঠিক পরিমাণে পানি খেলে ঘুম স্বাভাবিক থাকে, কিন্তু বেশি খাওয়া ঘুমের শত্রু হয়ে দাঁড়ায়।
৫. মস্তিষ্কে পানি জমা (সেরিব্রাল এডেমা)
অতিরিক্ত পানি খাওয়ার ফলে রক্ত পাতলা হয়ে কোষে পানি প্রবেশ করে। এতে কোষ ফুলে যায়, বিশেষ করে মস্তিষ্কের কোষ। একে বলা হয় সেরিব্রাল এডেমা। এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং জীবনহানির ঝুঁকি তৈরি করে। মস্তিষ্কে পানি জমলে মাথা ব্যথা, দৃষ্টি ঝাপসা, খিঁচুনি, এমনকি কোমায় চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই চিকিৎসকরা বারবার বলেন—পানি অতিরিক্ত খেলেও সমস্যা হতে পারে।
৬. হৃদযন্ত্রের উপর চাপ
হৃদপিণ্ড প্রতিনিয়ত রক্ত সঞ্চালন করে। অতিরিক্ত পানি খাওয়া হলে রক্তের পরিমাণ বেড়ে যায়। এতে হৃদপিণ্ডকে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি কাজ করতে হয়। হৃদযন্ত্র দুর্বল বা কার্ডিয়াক রোগীদের জন্য এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক। বাংলাদেশে হৃদরোগীর সংখ্যা বাড়ছে, তাই এদের জন্য “প্রতিদিন কত লিটার পানি খাওয়া উচিত” সেই সীমা মেনে চলা অপরিহার্য।
৭. লিভারের সমস্যা
লিভার আমাদের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যা পানি, পুষ্টি এবং টক্সিন প্রক্রিয়াজাত করে। যখন শরীরে অতিরিক্ত পানি প্রবেশ করে, তখন লিভারকে সেই ভারসাম্য রক্ষা করতে বাড়তি চাপ নিতে হয়। এর ফলে লিভারের স্বাভাবিক কার্যকারিতা নষ্ট হয় এবং হজমে সমস্যা দেখা দেয়। দীর্ঘদিন এই অবস্থা চললে লিভারের কার্যক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে।
৮. হজমে অসুবিধা
অনেকে খাবারের সময় বা খাবারের পরপরই প্রচুর পানি পান করেন। এতে হজম রস পাতলা হয়ে যায়, ফলে খাবার হজম হতে বেশি সময় লাগে। এতে গ্যাস, ফাঁপা, অস্বস্তি এবং হজমজনিত নানা সমস্যা দেখা দেয়। অতিরিক্ত পানি খাওয়ার কারণে পেট ভারী লাগে এবং ক্ষুধাও কমে যায়। সঠিক সময়ে এবং সঠিক পরিমাণে পানি খাওয়াই হজমের জন্য আদর্শ।
৯. শরীরে প্রয়োজনীয় খনিজের ঘাটতি
ঘন ঘন প্রস্রাবের মাধ্যমে শুধু পানি নয়, শরীর থেকে সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়ামসহ প্রয়োজনীয় খনিজ বের হয়ে যায়। এসব খনিজ শরীরের পেশি, স্নায়ু এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ। অতিরিক্ত পানি খাওয়ার ফলে এসব খনিজের ঘাটতি তৈরি হয়। এর ফলে পেশিতে টান ধরা, দুর্বলতা, মাথা ঘোরা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়।
১০. হঠাৎ মৃত্যু ঝুঁকি (ওয়াটার ইনটক্সিকেশন)
অতিরিক্ত পানি খাওয়ার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ফল হলো ওয়াটার ইনটক্সিকেশন। এটি এমন একটি অবস্থা যখন শরীর অতিরিক্ত পানি সামলাতে পারে না। হাইপোন্যাট্রেমিয়া মারাত্মক আকার ধারণ করে এবং দ্রুত অচেতনতা, খিঁচুনি ও মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা বা চ্যালেঞ্জে অংশ নেওয়া মানুষদের মধ্যে এই কারণে মৃত্যু ঘটেছে। তাই পানি যতই প্রয়োজনীয় হোক না কেন, অতিরিক্ত খাওয়া কখনোই উচিত নয়।
পানি পানের উপকারিতা?

পানি শুধু তৃষ্ণা মেটানোর জন্য নয়, শরীরের প্রতিটি কোষকে সচল রাখার মূল চাবিকাঠি। একজন মানুষ প্রতিদিন কত লিটার পানি খাওয়া উচিত তা যদি সঠিকভাবে মানা যায়, তাহলে শরীর সুস্থ ও সতেজ থাকে। পানি রক্ত সঞ্চালন থেকে শুরু করে হজম, মস্তিষ্কের কার্যক্রম, ত্বকের উজ্জ্বলতা—সবকিছুর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। তাই নিয়মিত পর্যাপ্ত পানি পান করা মানেই একটি প্রাকৃতিক ওষুধের মতো শরীরকে সুস্থ রাখা।
১. শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ
আমাদের শরীর সারাদিন নানা কারণে গরম হয়—কাজের চাপ, রোদে থাকা, ব্যায়াম করা ইত্যাদি। ঘামের মাধ্যমে শরীর অতিরিক্ত তাপ বের করে দেয়। পানি না থাকলে ঘাম কম হয় এবং শরীরের ভেতরে তাপ জমে যায়, যা হিটস্ট্রোক পর্যন্ত ঘটাতে পারে। পর্যাপ্ত পানি পান করলে ঘাম সহজে বের হয় এবং শরীর ঠান্ডা থাকে। গরমে কাজ করা মানুষদের জন্য পানি হলো প্রাকৃতিক এসি।
২. হজম শক্তি বাড়ায়
খাবার হজম করতে পাকস্থলীতে হজম রস তৈরি হয়। পানি এই রসকে সক্রিয় রাখে এবং খাবার ভেঙে দেয়। পানি ছাড়া খাবার অন্ত্রে আটকে যায়, ফলে গ্যাস, কোষ্ঠকাঠিন্য, অম্বল ইত্যাদি সমস্যা হয়। খাওয়ার আগে অল্প পানি পেটে গেলে পাকস্থলী প্রস্তুত হয়, আর খাওয়ার পর ৩০ মিনিট পরে পানি খেলে হজম সহজ হয়। বাংলাদেশের অনেক মানুষ অম্বলে ভোগেন, অথচ প্রতিদিন সঠিকভাবে পানি খাওয়া তাদের এই সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারে।
৩. রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক রাখে
রক্তের বড় অংশই পানি। পানি যথেষ্ট পরিমাণে না থাকলে রক্ত ঘন হয়ে যায়, ফলে সঞ্চালন ব্যাহত হয়। এতে মাথা ঘোরা, ক্লান্তি, এমনকি হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে। পর্যাপ্ত পানি খেলে রক্ত পাতলা হয় এবং শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে অক্সিজেন ও পুষ্টি পৌঁছে যায়। এজন্য ডাক্তাররা বলেন—রক্ত পরিষ্কার রাখতে পানি ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
৪. কিডনিকে সুস্থ রাখে
কিডনির প্রধান কাজ হলো শরীরের বর্জ্য বের করে দেওয়া। পানি সেই কাজকে সহজ করে। প্রস্রাবের মাধ্যমে টক্সিন বের হতে হলে পর্যাপ্ত পানি দরকার। পানি কম হলে কিডনিতে পাথর তৈরি হয়। অন্যদিকে, প্রতিদিন কত লিটার পানি খাওয়া উচিত সেই নিয়ম মেনে পানি খেলেই কিডনি পরিষ্কার থাকে এবং দীর্ঘদিন সুস্থভাবে কাজ করে। বাংলাদেশের গরম আবহাওয়ায় কিডনি সুস্থ রাখতে দিনে অন্তত ২-৩ লিটার পানি জরুরি।
৫. ত্বক উজ্জ্বল ও তারুণ্য ধরে রাখে
অনেকেই ত্বক সুন্দর রাখতে দামি প্রসাধনী ব্যবহার করেন, কিন্তু আসল সৌন্দর্য আসে ভেতর থেকে। পানি শরীরের ভেতর থেকে ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখে। পানি পর্যাপ্ত থাকলে ত্বক মসৃণ হয়, ফাটা বা রুক্ষ হয় না এবং উজ্জ্বলতা বেড়ে যায়। পানি বার্ধক্য রোধ করতেও সাহায্য করে, কারণ বলিরেখা ও শুষ্কতা অনেকটাই দূর হয়।
৬. ওজন কমাতে সাহায্য করে
ওজন কমাতে চাইলে পানি হলো সবচেয়ে সহজ এবং প্রাকৃতিক উপায়। খালি পেটে এক গ্লাস পানি খেলে পেট ভরা অনুভূতি হয়, ফলে অকারণে বেশি খাওয়া হয় না। পানি বিপাকক্রিয়া বাড়ায়, যার ফলে শরীরে ক্যালরি পোড়ার হার বেড়ে যায়। কোমল পানীয় বা জুস বাদ দিয়ে শুধু পানি খাওয়া ওজন কমাতে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি।
৭. শক্তি যোগায় ও ক্লান্তি দূর করে
শরীরে সামান্য পানিশূন্যতা হলেও আমরা ক্লান্তি, মাথা ঘোরা এবং মনোযোগের ঘাটতিতে ভুগি। পানি শরীরের কোষে অক্সিজেন পৌঁছে দেয় এবং শক্তি উৎপাদনে সাহায্য করে। কাজের ফাঁকে এক গ্লাস পানি খেলে শরীর আবার সতেজ হয়। এজন্য ছাত্রছাত্রী, অফিসকর্মী, শ্রমিক—সবারই পর্যাপ্ত পানি খাওয়া জরুরি।
৮. মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ায়
মস্তিষ্কের প্রায় ৭৫% পানি দিয়ে তৈরি। পানি কমে গেলে মনোযোগ কমে যায়, ভুলে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ে এবং চিন্তা করার ক্ষমতা হ্রাস পায়। পর্যাপ্ত পানি খেলে মস্তিষ্কে অক্সিজেন ও পুষ্টি পৌঁছে যায়, ফলে শেখা ও মনে রাখার ক্ষমতা বাড়ে। পরীক্ষার সময় ছাত্রদের জন্য পানি অপরিহার্য।
৯. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
পানি শরীরের ভেতরের টক্সিন বের করে দেয়। এতে শরীর পরিষ্কার থাকে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। পর্যাপ্ত পানি খেলে সর্দি, ফ্লু, সংক্রমণ ইত্যাদি অনেক রোগ সহজে আক্রমণ করতে পারে না। এছাড়া পানি শরীরে ভিটামিন ও খনিজ সঠিকভাবে পৌঁছে দেয়, যা রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে।
১০. গর্ভবতী মা ও শিশুর জন্য অপরিহার্য
গর্ভবতী মায়ের শরীরে নতুন প্রাণ বেড়ে ওঠে। সেই শিশুর জন্য পর্যাপ্ত পানি অপরিহার্য। পানি কম খেলে গর্ভবতী মায়ের কোষ্ঠকাঠিন্য, মাথা ঘোরা ও ডিহাইড্রেশনের সমস্যা হয়। এছাড়া শিশুর মস্তিষ্ক ও শরীর গঠনে পর্যাপ্ত পানি লাগে। স্তন্যদানকারী মায়েদের জন্যও পানি খুব জরুরি, কারণ দুধ উৎপাদনে সরাসরি পানির প্রয়োজন হয়।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর সমূহ
প্রতিদিন কত লিটার পানি খাওয়া উচিত এই বিষয়ে আপনার মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে? তাহলে চলুন জেনে নেই সেই সকল প্রশ্ন ও উত্তরগুলো-
প্রতিদিন কত লিটার পানি খাওয়া উচিত?
একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য গড়ে দিনে ২ থেকে ৩ লিটার পানি খাওয়া উচিত। তবে সঠিক পরিমাণ নির্ভর করে বয়স, ওজন, কাজের ধরণ এবং আবহাওয়ার ওপর। বাংলাদেশি প্রেক্ষাপটে যারা বেশি পরিশ্রম করেন বা গরমে বাইরে থাকেন, তাদের ৩ লিটার পর্যন্ত পানি প্রয়োজন হতে পারে।
পানি কম খেলে শরীরে কী ধরনের সমস্যা হয়?
পানি কম খেলে শরীর দ্রুত পানিশূন্য হয়ে যায়। এর ফলে মাথা ঘোরা, ক্লান্তি, কোষ্ঠকাঠিন্য, ত্বক শুষ্কতা, কিডনিতে পাথর, এমনকি ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন পর্যন্ত হতে পারে। তাই শরীর সুস্থ রাখতে প্রতিদিন কত লিটার পানি খাওয়া উচিত তা মেনে চলা খুবই জরুরি।
উপসংহার
পানি হলো জীবনের মূল উপাদান। আমরা প্রতিদিন যে খাবার খাই, অক্সিজেন গ্রহণ করি, তার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো পানি। একজন মানুষ খাবার ছাড়া কয়েকদিন বেঁচে থাকতে পারেন, কিন্তু পানি ছাড়া বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। তাই “প্রতিদিন কত লিটার পানি খাওয়া উচিত”—এই প্রশ্ন শুধু স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের নয়, বরং প্রত্যেকের জীবনের জন্য জরুরি।
বাংলাদেশের মতো গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ার দেশে পানির প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি। কৃষক, শ্রমিক, গার্মেন্টস কর্মী থেকে শুরু করে অফিসকর্মী—সবাইকে শরীরের চাহিদা অনুযায়ী পানি খেতে হয়। আবার শিশু, গর্ভবতী মা, স্তন্যদানকারী নারী ও বৃদ্ধদের পানির চাহিদাও আলাদা। তাই একক কোনো নিয়ম সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। তবে গড় হিসেবে প্রতিদিন ২–৩ লিটার পানি খাওয়াই যথেষ্ট।
আমরা অনেক সময় ভুল করি—তৃষ্ণা পেলেই শুধু পানি খাই। অথচ তৃষ্ণা লাগা মানেই শরীরে পানির ঘাটতি শুরু হয়েছে। তাই তৃষ্ণার অপেক্ষা না করে সময়মতো পানি খাওয়ার অভ্যাস তৈরি করতে হবে। যেমন—সকালে ঘুম থেকে উঠে, কাজের ফাঁকে, খাবারের আগে ও পরে নির্দিষ্ট সময়ে পানি খাওয়া।
পানি কম খেলে নানা রোগ হয়—কিডনিতে পাথর, প্রস্রাবের সংক্রমণ, কোষ্ঠকাঠিন্য, মাথাব্যথা, ত্বক শুষ্কতা ইত্যাদি। আবার পানি বেশি খেলেও ক্ষতি হয়—রক্তে সোডিয়ামের ভারসাম্য নষ্ট হয়, কিডনির ওপর চাপ পড়ে, ঘুমের সমস্যা তৈরি হয় এমনকি মারাত্মক অবস্থায় মৃত্যুও ঘটতে পারে। তাই প্রয়োজন অনুযায়ী পানি খাওয়াই হলো সঠিক উপায়।
শরীরের ওজন, কাজের ধরণ, আবহাওয়া ও স্বাস্থ্যের অবস্থা অনুযায়ী পানি খাওয়ার পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, গরমকালে বা শারীরিক পরিশ্রম করলে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পানি খাওয়া উচিত। তবে রাতের ঘুমের আগে অতিরিক্ত পানি খাওয়া এড়াতে হবে।
শিশুদের পানির প্রতি অনীহা দূর করতে তাদেরকে ছোট ছোট বিরতিতে পানি দেওয়া উচিত। বয়স্কদের ক্ষেত্রে নিয়মিত মনে করিয়ে দিতে হবে। গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মায়েদের জন্য পানি অপরিহার্য, কারণ এটি শুধু তাদের নয়, শিশুরও সুস্থতা নিশ্চিত করে।
মনে রাখতে হবে, পানি হলো সবচেয়ে সহজলভ্য এবং সবচেয়ে সস্তা প্রাকৃতিক ওষুধ। এটির কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই, যদি সঠিক পরিমাণে খাওয়া হয়। তাই আমাদের সবার উচিত প্রতিদিন কত লিটার পানি খাওয়া উচিত সেটি মেনে চলা এবং পরিবার ও সমাজে পানি খাওয়ার সঠিক অভ্যাস গড়ে তোলা।
সুস্থ থাকতে চাইলেই বাজারের দামি ওষুধ নয়, বরং এক গ্লাস বিশুদ্ধ পানি হতে পারে সেরা সমাধান। কাজেই প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান করুন, শরীরকে দিন নতুন সতেজতা, আর রোগ-ব্যাধি থেকে থাকুন দূরে।
