লাউ গাছের গোড়া পচা রোগের প্রতিকার?
বাংলাদেশে লাউ একটি অতি পরিচিত ও জনপ্রিয় সবজি, যা প্রায় সারা বছরই চাষ করা যায়। এটি শুধু খাবার নয়, বরং আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও অর্থনীতির সঙ্গেও গভীরভাবে যুক্ত। গ্রামীণ পরিবেশে অনেক বাড়ির আঙিনায়, মাচার নিচে কিংবা জমিতে লাউ ঝুলতে দেখা যায়। লাউ দিয়ে রান্না করা ভাজি, তরকারি, ডাল কিংবা মাছের ঝোল বাঙালির রসনায় আলাদা স্বাদ যোগ করে। শুধু স্বাদ নয়, লাউয়ে রয়েছে ভিটামিন ‘সি’, ভিটামিন ‘বি’, ক্যালসিয়াম, আয়রন ও আঁশসহ নানা ধরনের পুষ্টিগুণ। এটি শরীর ঠান্ডা রাখে, হজমে সহায়তা করে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
লাউ চাষের জন্য বিশেষ জমি বা পরিবেশের প্রয়োজন হয় না। সামান্য যত্ন নিলেই ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব। তবে কৃষকের সবচেয়ে বড় সমস্যার মধ্যে একটি হলো গাছের রোগবালাই। লাউ গাছে পোকা-মাকড়ের আক্রমণ যেমন দেখা যায়, তেমনি বিভিন্ন ধরনের ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে গাছ আক্রান্ত হয়।
এর মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ এবং ক্ষতিকর রোগ হলো গোড়া পচা রোগ। এ রোগ হলে প্রথমে গাছের গোড়ায় দাগ পড়ে, তারপর তা নরম হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে গোড়া ভেঙে গাছ মরে যায়। এর ফলে লাউয়ের ফলন হ্রাস পায়, কৃষক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং অনেক সময় পুরো ক্ষেত নষ্ট হয়ে যায়।
বাংলাদেশের উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া, বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি জমে থাকা, এবং অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে গোড়া পচা রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া নিম্নমানের বীজ, মাটির সঠিক পরিচর্যা না করা এবং বারবার একই জমিতে লাউ চাষ করাও এই রোগের বিস্তারের অন্যতম কারণ। ফলে কৃষকেরা প্রায়ই এই রোগ নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন।
তবে সুসংবাদ হলো— সঠিক পরিচর্যা, জমি প্রস্তুতি, বীজ শোধন, জৈব সার প্রয়োগ, সময়মতো সেচ, রোগ প্রতিরোধী জাত নির্বাচন এবং প্রয়োজনে ছত্রাকনাশক ব্যবহারের মাধ্যমে এই রোগ অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তাই কৃষকদের অবশ্যই এ রোগ সম্পর্কে সচেতন হওয়া জরুরি এবং প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
লাউ গাছের গোড়া পচা রোগের প্রতিকার?

লাউ গাছের গোড়া পচা রোগ বাংলাদেশের চাষিদের জন্য একটি বড় সমস্যা। সাধারণত ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ, অতিরিক্ত পানি জমা এবং মাটির সঠিক পরিচর্যা না করার কারণে এ রোগ হয়। ফলে গাছ শুকিয়ে যায় এবং ফলন কমে যায়। তবে সঠিক পদক্ষেপ নিলে এ রোগকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। নিচে ধাপে ধাপে ১০টি কার্যকর প্রতিকারমূলক উপায় আলোচনা করা হলো।
১. রোগ সনাক্তকরণ
লাউ গাছের গোড়া পচা রোগের প্রতিকার শুরু করার আগে রোগ সঠিকভাবে সনাক্ত করা অত্যন্ত জরুরি। প্রথমে আক্রান্ত গাছের গোড়ায় কালো বা বাদামি দাগ দেখা যায়। দাগ ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে এবং গোড়ার অংশ নরম হয়ে যায়। এ সময়ে গাছের পাতা হলুদ হয়ে ঝুলে পড়তে শুরু করে। রোগের অগ্রগতি হলে গাছ শুকিয়ে মারা যায়। অনেক কৃষক প্রাথমিক অবস্থায় এ লক্ষণগুলোকে সাধারণ মনে করে উপেক্ষা করেন।
কিন্তু প্রাথমিক অবস্থায় ব্যবস্থা না নিলে তা দ্রুত আশেপাশের গাছে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে গাছ পরিদর্শন করলে সহজে রোগ সনাক্ত করা যায়। গাছের গোড়া হাত দিয়ে টিপে নরম হলে বুঝতে হবে রোগ শুরু হয়েছে। কৃষকদের এই ধাপটি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। কারণ সময়মতো সনাক্তকরণই হলো গোড়া পচা রোগ নিয়ন্ত্রণের প্রথম ধাপ।
২. জমি প্রস্তুত করা
লাউ গাছের গোড়া পচা রোগের প্রতিকার করতে হলে জমি প্রস্তুতির দিকে সর্বপ্রথম নজর দিতে হবে। জমি যেন নিচু না হয় এবং বৃষ্টির পানি জমে না থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। জমি চাষের সময় একাধিকবার গভীরভাবে চাষ দিয়ে মাটি ঝরঝরে করতে হবে। চাষের সময় পর্যাপ্ত পরিমাণে পচা গোবর, কেঁচো সার বা কম্পোস্ট সার মিশিয়ে দিতে হবে।
এতে মাটির উর্বরতা বাড়ে এবং জীবাণুর ভারসাম্য বজায় থাকে। বর্ষার মৌসুমে জমি সামান্য উঁচু করে বেড তৈরি করলে পানি দ্রুত বের হয়ে যায়। আবার শুকনো মৌসুমে জমিতে আর্দ্রতা ধরে রাখার জন্য মালচিং পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। জমি প্রস্তুতের সময় রোগমুক্ত আগের ফসলের অবশিষ্টাংশ মাটি থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। কারণ এসব অবশিষ্টাংশে রোগজীবাণু লুকিয়ে থাকতে পারে। জমি প্রস্তুতিতে যত যত্ন নেয়া হবে, তত বেশি লাউ চাষ সাফল্যমণ্ডিত হবে।
৩. বীজ শোধন
অনেক সময় লাউ গাছের গোড়া পচা রোগের জীবাণু বীজের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তাই বীজ বপনের আগে শোধন করা অপরিহার্য। সাধারণত কৃষকরা সরাসরি বাজার থেকে বীজ কিনে জমিতে বপন করেন। কিন্তু এভাবে করলে রোগের ঝুঁকি বাড়ে। শোধনের জন্য বীজকে কার্বেনডাজিম বা থাইরাম জাতীয় ছত্রাকনাশকের দ্রবণে ২-৩ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখা উচিত। চাইলে গরম পানিতে (৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ৩০ মিনিট রেখে বীজ শোধন করা যায়।
অনেক কৃষক দেশীয় পদ্ধতিতে নিমপাতার রস ব্যবহার করে থাকেন, সেটিও কার্যকর। শোধন করা বীজ থেকে সুস্থ চারা জন্মায় এবং রোগের সংক্রমণ অনেকাংশে কমে যায়। বীজ শোধনের মাধ্যমে একদিকে রোগ প্রতিরোধ করা যায়, অন্যদিকে লাউ চাষের ফলনও বাড়ে। তাই প্রতিটি কৃষকের উচিত বীজ শোধনকে নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত করা।
৪. সেচ ব্যবস্থা
সঠিক সেচ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা লাউ গাছের গোড়া পচা রোগের প্রতিকার করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাছের গোড়ায় পানি জমে থাকলে রোগের জীবাণু দ্রুত সক্রিয় হয়। তাই জমিতে পানি নিষ্কাশনের জন্য নালা তৈরি করা উচিত। বর্ষার সময় গাছের গোড়ায় অতিরিক্ত পানি জমে না থাকে সে দিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।
শুষ্ক মৌসুমে আবার নিয়মিত সেচ দিতে হবে যাতে মাটিতে আর্দ্রতা থাকে। তবে সেচ দেওয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন অতিরিক্ত পানি গাছের গোড়ায় স্থায়ীভাবে না থাকে। অনেক কৃষক ড্রিপ সেচ ব্যবহার করেন, যা খুবই কার্যকর। কারণ এতে পানি সরাসরি গাছের গোড়ায় যায় এবং জমিতে পানি জমে থাকে না। সঠিক সেচ ব্যবস্থা শুধু রোগ প্রতিরোধই করে না, বরং গাছের বৃদ্ধি এবং ফলনের ওপরও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
৫. জৈব সার ব্যবহার
জৈব সার মাটির উর্বরতা বাড়ানোর পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। লাউ গাছের গোড়া পচা রোগের প্রতিকার হিসেবে নিয়মিত গোবর সার, কেঁচো সার, কম্পোস্ট সার এবং জৈব তরল সার ব্যবহার করলে মাটিতে উপকারী জীবাণু সক্রিয় হয়। এ জীবাণুগুলো ক্ষতিকর ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়াকে দমন করে। বিশেষ করে ভার্মি কম্পোস্ট সার গাছের শিকড় শক্তিশালী করে এবং মাটির গুণগত মান উন্নত করে।
রাসায়নিক সারের তুলনায় জৈব সার বেশি নিরাপদ এবং দীর্ঘস্থায়ী উপকার দেয়। অনেক কৃষক রোগ প্রতিরোধে নিম খোল ব্যবহার করেন, যা ছত্রাক দমনে কার্যকর। জমিতে পর্যাপ্ত জৈব সার ব্যবহারের ফলে গাছ সবল হয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এবং ফলনও ভালো হয়। তাই জৈব সার ব্যবহার করা উচিত নিয়মিত অভ্যাস হিসেবে।
৬. রোগাক্রান্ত গাছ সরানো
যে গাছগুলোতে গোড়া পচা রোগ দেখা দেয় সেগুলো দ্রুত তুলে ফেলা অত্যন্ত জরুরি। আক্রান্ত গাছ জমিতে রেখে দিলে আশেপাশের সুস্থ গাছে রোগ ছড়িয়ে পড়ে। আক্রান্ত গাছ মাটি থেকে তুলে এনে জমির বাইরে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলা উচিত। অনেকে আক্রান্ত গাছ জমির মধ্যে ফেলে রাখেন, যা অন্য গাছকে আক্রান্ত করে। গাছ তুলে ফেলার পর সেই স্থানে চুন ছিটিয়ে দিতে হবে যাতে জীবাণু মারা যায়। যদি সম্ভব হয়, আক্রান্ত গাছের আশেপাশের কিছু অংশও খুঁড়ে ফেলে দিতে হবে। এতে নতুন চারা বা লতা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে। এ পদ্ধতিটি সাময়িকভাবে কষ্টকর মনে হলেও দীর্ঘমেয়াদে জমি রোগমুক্ত রাখতে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
৭. ছত্রাকনাশক ব্যবহার
যখন রোগ মারাত্মক আকার ধারণ করে, তখন ছত্রাকনাশক ব্যবহার ছাড়া উপায় থাকে না। বাজারে পাওয়া যায় এমন অনেক ছত্রাকনাশক যেমন— ম্যানকোজেব, কার্বেনডাজিম, ক্যাপটান ইত্যাদি নিয়মিত ব্যবহারে রোগ অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তবে সঠিক মাত্রা ও ব্যবহারের সময়সূচি মেনে চলতে হবে।
অনেক কৃষক অযথা বেশি ওষুধ ব্যবহার করেন, যা গাছ ও মাটির জন্য ক্ষতিকর। তাই কৃষি বিশেষজ্ঞ বা কৃষি অফিসারের পরামর্শ নিয়ে ছত্রাকনাশক ব্যবহার করা উচিত। গাছের গোড়ায় মিশ্রিত দ্রবণ স্প্রে করার পাশাপাশি গোড়ার মাটিতে প্রয়োগ করলে কার্যকরভাবে জীবাণু দমন করা যায়। তবে বারবার একই ওষুধ ব্যবহার না করে পরিবর্তন করে ব্যবহার করা ভালো।
৮. জৈব প্রতিকার
প্রাকৃতিক উপায়ে রোগ দমন অনেক সময় রাসায়নিকের চেয়ে বেশি কার্যকর এবং নিরাপদ। ট্রাইকোডার্মা হারজিয়ানাম নামক উপকারী ছত্রাক ব্যবহার করলে ক্ষতিকর জীবাণু দমন হয়। এ ছত্রাক মাটিতে মিশিয়ে দিলে দীর্ঘ সময় কার্যকর থাকে।
এছাড়া নিমপাতার রস, নিম তেল, রসুনের রস ইত্যাদি প্রাকৃতিক কীটনাশক ব্যবহার করলে গাছ শক্তিশালী হয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। এসব জৈব প্রতিকার ব্যবহার করলে পরিবেশ দূষণ হয় না, মাটির স্বাস্থ্য বজায় থাকে এবং উৎপাদিত লাউও বিষমুক্ত থাকে। বর্তমানে অনেক কৃষক অর্গানিক লাউ চাষ করছেন, যেখানে এ ধরনের জৈব প্রতিকারই প্রধান ভরসা।
৯. মাটি জীবাণুমুক্ত করা
গোড়া পচা রোগের জীবাণু প্রায়ই মাটির ভেতরে লুকিয়ে থাকে। তাই জমি প্রস্তুতের আগে মাটিকে জীবাণুমুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি। এজন্য মাটিকে ২০-২৫ দিন সূর্যের তাপে প্লাস্টিক দিয়ে ঢেকে রাখা যায়। এতে উচ্চ তাপে জীবাণু ধ্বংস হয়।
অনেক সময় চুন ব্যবহার করেও মাটি জীবাণুমুক্ত করা হয়। আবার অনেকে আগের ফসল কেটে ফেলার পর মাটিতে জৈব সার মিশিয়ে জীবাণু দমন করেন। মাটি জীবাণুমুক্ত করার ফলে শুধু লাউ গাছ নয়, অন্যান্য সবজি গাছও রোগমুক্ত থাকে। তাই প্রতিটি মৌসুমের আগে মাটি জীবাণুমুক্ত করার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত।
১০. ফসলের পালা পরিবর্তন
একই জমিতে বারবার লাউ চাষ করলে রোগের জীবাণু মাটিতে থেকে যায় এবং নতুন গাছেও আক্রমণ করে। তাই ফসলের পালা পরিবর্তন করা অত্যন্ত জরুরি। এক মৌসুমে লাউ চাষের পর পরবর্তী মৌসুমে অন্য কোনো সবজি যেমন ঢেঁড়স, মিষ্টি কুমড়া, শসা, ভুট্টা বা ডাল জাতীয় ফসল চাষ করা উচিত। এতে মাটিতে থাকা জীবাণু দুর্বল হয়ে যায়। পাশাপাশি জমির উর্বরতাও বৃদ্ধি পায়। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলেন, ২-৩ মৌসুম পরপর ফসল পরিবর্তন করলে জমি রোগমুক্ত থাকে এবং ফলনও ভালো হয়।
বারোমাসি লাউ চাষ পদ্ধতি?

বাংলাদেশের আবহাওয়ায় লাউ চাষ একটি জনপ্রিয় ও লাভজনক কৃষি কার্যক্রম। বিশেষত বারোমাসি লাউ চাষ করলে কৃষকরা সারা বছর ধারাবাহিকভাবে ফলন পেতে পারেন। এ পদ্ধতিতে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, উন্নত জাত নির্বাচন, সঠিক জমি প্রস্তুত এবং পরিচর্যা অত্যন্ত জরুরি। নিচে ধাপে ধাপে বারোমাসি লাউ চাষের ১০টি কার্যকর দিক তুলে ধরা হলো।
১. উপযুক্ত জাত নির্বাচন
বারোমাসি লাউ চাষ পদ্ধতির মূল ভিত্তি হলো সঠিক জাত নির্বাচন। সব জাত সারা বছর ফলন দেয় না। তাই কৃষককে বিশেষভাবে বারোমাসি জাত বেছে নিতে হয়। বর্তমানে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে উন্নত জাত সরবরাহ করা হচ্ছে, যেমন — বারোমাসি লাউ-১, বারোমাসি লাউ-২, হাইব্রিড জাত ইত্যাদি।
এসব জাতের বিশেষত্ব হলো দীর্ঘ সময় ধরে ফুল ও ফল দেয়। এগুলো সাধারণ রোগবালাই প্রতিরোধে সক্ষম এবং ফলের আকার, স্বাদ ও গুণগত মান বজায় রাখে। কৃষকদের উচিত বীজ কেনার সময় নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে সংগ্রহ করা। অনেক সময় স্থানীয় বাজার থেকে নিম্নমানের বীজ কিনলে ফলন কমে যায়। তাই বারোমাসি লাউ চাষের জন্য জাত নির্বাচনে সর্বাধিক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
২. জমি নির্বাচন ও প্রস্তুতি
বারোমাসি লাউ চাষের জন্য উঁচু ও পানি নিষ্কাশনযোগ্য জমি বেছে নিতে হবে। নিচু জমিতে পানি জমে থাকলে শিকড় পচে গাছ মারা যায়। জমি প্রস্তুতের সময় অন্তত ৪–৫ বার গভীরভাবে চাষ দিতে হবে। এতে মাটি ঝুরঝুরে হয় এবং শিকড় বিস্তারে সুবিধা হয়। চাষের সময় ১৫-২০ দিন আগে থেকেই প্রতি শতকে ৮-১০ কেজি পচা গোবর, ১ কেজি টিএসপি, ৫০০ গ্রাম এমওপি ও প্রয়োজনীয় পরিমাণ ইউরিয়া মিশিয়ে দিতে হবে।
এরপর জমি সমান করে উঁচু বেড তৈরি করতে হবে। পানি নিষ্কাশনের জন্য নালা রাখা জরুরি। বেড মালচিং করলে আর্দ্রতা ধরে রাখা যায়। জমি প্রস্তুতের সময় রোগমুক্ত আগের ফসলের অবশিষ্টাংশ সরিয়ে ফেলতে হবে। কারণ এসব অবশিষ্টাংশে রোগজীবাণু থেকে গিয়ে নতুন ফসল নষ্ট করতে পারে।
৩. বীজ বপন পদ্ধতি
বারোমাসি লাউ চাষে বীজ বপন একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। প্রথমেই বীজ শোধন করা জরুরি, যাতে রোগজীবাণু নষ্ট হয়। সাধারণত মার্চ–এপ্রিল এবং আগস্ট–সেপ্টেম্বর মাসে বীজ বপন সবচেয়ে ভালো ফল দেয়। তবে উন্নত জাত ব্যবহারে সারা বছর বপন করা সম্ভব।
বীজ সরাসরি বেডে বপন করা যায় অথবা প্রথমে পলিব্যাগে চারা তৈরি করে জমিতে রোপণ করা যেতে পারে। বপনের সময় প্রতি গর্তে ২–৩টি বীজ দিতে হবে এবং ৫–৭ দিন পর সুস্থ একটি চারা রেখে বাকিগুলো তুলে ফেলতে হবে। বীজ বপনের পরপরই হালকা সেচ দিলে অঙ্কুরোদগম ভালো হয়। সঠিক দূরত্ব বজায় রেখে বীজ বপন করলে গাছ পর্যাপ্ত আলো, বাতাস ও পুষ্টি পায়, যা ফলনের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
৪. সার ব্যবস্থাপনা
বারোমাসি লাউ চাষের ক্ষেত্রে সার ব্যবস্থাপনা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমে জমিতে বেসাল ডোজ হিসেবে গোবর, টিএসপি ও এমওপি দিতে হবে। এরপর গাছের বয়স অনুযায়ী টপ ড্রেসিং করতে হবে। সাধারণত গাছ লাগানোর ২০–২৫ দিন পর প্রথম ইউরিয়া ডোজ দিতে হয়। এরপর প্রতি ১৫–২০ দিন অন্তর ইউরিয়া ও এমওপি মিশিয়ে দিতে হবে।
প্রতিবার সার দেওয়ার পর সেচ দিলে গাছ দ্রুত সার গ্রহণ করে। জৈব সার যেমন কম্পোস্ট, কেঁচো সার ও নিম খোল ব্যবহার করলে গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। অনেক কৃষক তরল জৈব সার ব্যবহার করেন, যা পাতায় স্প্রে করলে দ্রুত কার্যকর হয়। সঠিক সার ব্যবস্থাপনা গাছের ফুল-ফল ঝরাপড়া কমায় এবং দীর্ঘ সময় ফলন ধরে রাখে।
৫. সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা
লাউ গাছের শিকড় মাটির গভীরে বিস্তৃত হলেও নিয়মিত আর্দ্রতা দরকার। বারোমাসি চাষে শুষ্ক মৌসুমে ৭–১০ দিন অন্তর সেচ দিতে হবে। বৃষ্টির মৌসুমে আবার পানি জমে থাকলে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। অতিরিক্ত পানি জমে থাকলে গোড়াপচা রোগ হয়। এজন্য নালা তৈরি করে রাখা উচিত।
অনেক কৃষক বর্তমানে ড্রিপ সেচ ব্যবহার করছেন, যা পানির সাশ্রয় করে এবং শিকড় পর্যাপ্ত পানি পায়। সেচ দেওয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে, যেন গাছের গোড়ায় দীর্ঘ সময় ভেজা না থাকে। সঠিক সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা গাছকে সবল রাখে এবং দীর্ঘ সময় ফলন দিতে সহায়তা করে।
৬. মাচা তৈরি
বারোমাসি লাউ চাষে মাচা তৈরি অত্যন্ত জরুরি। মাচা না করলে লতা মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে এবং ফল মাটির সংস্পর্শে থেকে রোগাক্রান্ত হয়। সাধারণত ৬–৭ ফুট উঁচু বাঁশ বা কাঠের মাচা তৈরি করা হয়। গাছ লাগানোর ১৫–২০ দিনের মধ্যে মাচা তৈরি শুরু করতে হবে। মাচা করলে লতা উপরে ওঠে এবং পর্যাপ্ত আলো-বাতাস পায়।
ফলে ফুল ও ফল ভালো হয়। এছাড়া গাছের পরিচর্যা, সেচ, সার প্রয়োগ ও রোগবালাই দমন সহজ হয়। বর্তমানে অনেক কৃষক জালের মাচা ব্যবহার করেন, যা টেকসই ও খরচ সাশ্রয়ী। ভালো মাচা থাকলে ফলের গুণগত মান বজায় থাকে এবং ফল বাজারে বেশি দামে বিক্রি হয়।
৭. আগাছা ও পরিচর্যা
বারোমাসি লাউ চাষে নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করা প্রয়োজন। আগাছা গাছের পুষ্টি, আলো ও পানির জন্য প্রতিযোগিতা করে। এছাড়া অনেক সময় আগাছায় কীটপতঙ্গ ও রোগজীবাণু আশ্রয় নেয়। তাই প্রতি ১৫–২০ দিন অন্তর আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
গাছ বড় হলে লতা ছাঁটাই করা দরকার, যাতে নতুন ডালপালা জন্মায় এবং ফলন বাড়ে। ফুল ফোটার সময় অতিরিক্ত ডাল ছেঁটে দিলে গাছ বেশি ফল ধরে। পরিচর্যার অংশ হিসেবে নিয়মিত গাছ পরিদর্শন করা জরুরি। পোকামাকড় বা রোগ দেখা দিলে প্রাথমিক অবস্থায় ব্যবস্থা নিতে হবে। নিয়মিত পরিচর্যা করলে গাছ সুস্থ থাকে এবং বারোমাসি লাউ চাষ সফল হয়।
৮. রোগবালাই দমন
লাউ গাছ সাধারণত ডাউনি মিলডিউ, পাউডারি মিলডিউ, গোড়াপচা রোগ, ফল ছিদ্রকারী পোকা ইত্যাদিতে আক্রান্ত হয়। বারোমাসি চাষে যেহেতু সারা বছর গাছ থাকে, তাই রোগবালাইয়ের ঝুঁকিও বেশি। এজন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। বীজ শোধন, জমি জীবাণুমুক্তকরণ, সঠিক সেচ ও সার ব্যবস্থাপনা রোগ দমন করে।
রোগ দেখা দিলে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক যেমন ম্যানকোজেব, কার্বেনডাজিম ব্যবহার করা যায়। এছাড়া নিম তেল, ট্রাইকোডার্মা ইত্যাদি জৈব প্রতিকারও কার্যকর। নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করলে রোগ দ্রুত শনাক্ত করা যায় এবং ক্ষতি কমানো সম্ভব হয়। রোগবালাই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেই বারোমাসি লাউ চাষ দীর্ঘস্থায়ীভাবে লাভজনক হয়।
৯. ফুল ও ফল ধারণ
বারোমাসি লাউ গাছে সাধারণত পুরুষ ফুল বেশি ফোটে, তবে ফলনের জন্য স্ত্রী ফুল জরুরি। তাই গাছে পুরুষ ও স্ত্রী ফুলের অনুপাত সমন্বয় করতে হয়। গাছ পর্যাপ্ত পুষ্টি না পেলে বা আবহাওয়া প্রতিকূল হলে ফল ঝরে যায়। এজন্য ফুল ফোটার সময় বাড়তি সার ও সেচ দেওয়া দরকার। অনেক সময় কৃত্রিম পরাগায়ন করতে হয়,
বিশেষত বর্ষাকালে যখন মৌমাছি কম সক্রিয় থাকে। কৃত্রিম পরাগায়নে হাত দিয়ে পুরুষ ফুলের পরাগ স্ত্রী ফুলে স্থানান্তর করতে হয়। এতে ফলন অনেক বেড়ে যায়। ফল গজানোর পর নিয়মিত পরিচর্যা করলে ফল দীর্ঘ সময় ধরে সংগ্রহ করা যায়।
১০. ফল সংগ্রহ ও বাজারজাতকরণ
বারোমাসি লাউ গাছ সাধারণত বীজ বপনের ৫০–৬০ দিনের মধ্যে ফল দিতে শুরু করে। ফলের আকার ও পরিপক্বতার ওপর ভিত্তি করে প্রতি ৩–৪ দিন অন্তর ফল সংগ্রহ করতে হয়। বাজার চাহিদা অনুযায়ী ছোট বা মাঝারি আকারের ফল বেশি বিক্রি হয়। ফল সংগ্রহের সময় ধারালো ছুরি দিয়ে কেটে নিতে হবে, যেন লতার ক্ষতি না হয়।
সংগৃহীত ফল ছায়াযুক্ত স্থানে সংরক্ষণ করতে হবে। বাজারজাতকরণের সময় ফলের আকার, রঙ ও গুণগত মান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সুন্দর, দাগমুক্ত ও সমান আকারের লাউ বেশি দামে বিক্রি হয়। তাই সংগ্রহ ও বাজারজাতকরণের দিকে কৃষককে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
লাউ গাছের পোকা দমন?

বাংলাদেশে লাউ চাষ লাভজনক হলেও পোকামাকড়ের আক্রমণ বড় একটি সমস্যা। লাউ গাছের বিভিন্ন অংশে আক্রমণ করে পোকা গাছের বৃদ্ধি কমিয়ে দেয়, ফুল ও ফল ঝরিয়ে দেয় এবং বাজারজাতকরণে ক্ষতি করে। তাই সঠিক সময়ে পোকা শনাক্ত করে কার্যকর দমন ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
১. লাউ গাছের পোকা চেনার গুরুত্ব
পোকা দমনের আগে অবশ্যই সঠিকভাবে চেনা দরকার। লাউ গাছে সাধারণত ফল ছিদ্রকারী পোকা, লাউ মাছি, লিফ বিটল, মিলিবাগ ও এফিড দেখা যায়। প্রতিটি পোকার আক্রমণের ধরন আলাদা। যেমন ফল ছিদ্রকারী পোকা ফল নষ্ট করে, আবার লিফ বিটল পাতা খেয়ে ফেলে।
যদি কৃষক পোকা চিনতে না পারেন, তবে ভুল ওষুধ ব্যবহার করে সময় ও টাকা নষ্ট হবে। তাই নিয়মিত ক্ষেতে গিয়ে পোকা পর্যবেক্ষণ করা এবং সঠিকভাবে শনাক্ত করাই প্রথম কাজ। কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের পরামর্শ বা কৃষি বিশেষজ্ঞদের সাহায্যে পোকা চেনা সহজ হয়।
২. ফল ছিদ্রকারী পোকা দমন
ফল ছিদ্রকারী পোকা লাউ চাষের সবচেয়ে ক্ষতিকর শত্রু। এরা ফলের গায়ে ডিম পাড়ে এবং লার্ভা ভেতরে ঢুকে ফল খেয়ে ফেলে। ফলে ফল ভেতর থেকে পচে যায় ও বিক্রি অযোগ্য হয়ে পড়ে। প্রতিকার হিসেবে আক্রান্ত ফল দ্রুত তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। ক্ষেতে ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করলে এ পোকার সংখ্যা কমে যায়।
জৈব প্রতিকার হিসেবে নিমের বীজের তেল স্প্রে করা যেতে পারে। প্রয়োজনে অনুমোদিত কীটনাশক যেমন কার্বারিল বা স্পিনোসাড ব্যবহার করা যায়। তবে ফল সংগ্রহের অন্তত ১০ দিন আগে স্প্রে বন্ধ করতে হবে।
৩. লাউ মাছি দমন
লাউ মাছি ফুল ও কচি ফলে ডিম পাড়ে এবং লার্ভা ভেতরে ঢুকে ফল নষ্ট করে। এদের আক্রমণে ফল ঝরে যায় এবং অনেক সময় ফল বিকৃত হয়। প্রতিকার হিসেবে সকালে ও বিকেলে ক্ষেতে হলুদ স্টিকি ট্র্যাপ ব্যবহার করা যায়।
আক্রান্ত ফল সংগ্রহ করে ধ্বংস করতে হবে। নিম তেল বা সাবানের পানি স্প্রে করলে এদের দমন সম্ভব হয়। অনেক কৃষক ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করেন, যা পরিবেশবান্ধব ও কার্যকর। রাসায়নিক প্রয়োজনে ইমিডাক্লোপ্রিড ব্যবহার করা যেতে পারে।
৪. লিফ বিটল দমন
লিফ বিটল পাতার সবুজ অংশ খেয়ে ফেলে, ফলে পাতা ঝাঁঝরা হয়ে যায় এবং গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। বিশেষত ছোট চারার সময় এদের আক্রমণ বেশি ক্ষতিকর।
প্রতিকার হিসেবে চারার আশেপাশে আগাছা পরিষ্কার রাখতে হবে। সকালে হাতে ধরে এদের মেরে ফেলা যায়। জৈব প্রতিকার হিসেবে নিমপাতার রস স্প্রে করলে ভালো কাজ করে। রাসায়নিক প্রতিকারের জন্য কার্বারিল জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে সবসময় পরিমাণমতো ব্যবহার করতে হবে।
৫. মিলিবাগ দমন
মিলিবাগ গাছের কচি ডগা ও পাতায় আঠালো পদার্থ সৃষ্টি করে। এরা গাছের রস শুষে নেয়, ফলে গাছ দুর্বল হয়ে যায়। এরা সাধারণত কলোনি আকারে আক্রমণ করে এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিকার হিসেবে আক্রান্ত অংশ কেটে ফেলতে হবে। সাবান পানি বা নিম তেল স্প্রে করলে কার্যকর ফল পাওয়া যায়।
এছাড়া প্রাকৃতিক শত্রু যেমন লেডি বার্ড বিটল মিলিবাগ খেয়ে ফেলে। রাসায়নিক প্রয়োজনে ডাইমেথোয়েট ব্যবহার করা যেতে পারে।
৬. এফিড বা পাতা উকুন দমন
এফিড গাছের পাতায় কলোনি আকারে বসে রস শুষে নেয়। এরা ভাইরাসও ছড়াতে পারে, ফলে গাছ মরে যেতে পারে। প্রতিকার হিসেবে গাছে পানি ছিটালে অনেক এফিড পড়ে যায়।
নিম তেল বা সাবান পানি স্প্রে করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। এছাড়া গাছের আশেপাশে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। প্রাকৃতিক শত্রু যেমন লেডি বার্ড বিটল এফিড দমন করতে সহায়ক। প্রয়োজনে অ্যাসিটামিপ্রিড বা ইমিডাক্লোপ্রিড ব্যবহার করা যায়।
৭. আগাছা ও পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা
পোকামাকড় অনেক সময় আগাছায় আশ্রয় নেয় এবং সেখান থেকে মূল ফসলে ছড়িয়ে পড়ে। তাই নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করা দরকার। জমির আশেপাশে গাছের অবশিষ্টাংশ জমে থাকলেও পোকার প্রজনন হয়।
আগাছা পরিষ্কার ও জমি পরিচ্ছন্ন রাখলে অনেক পোকা প্রতিরোধ করা যায়। এছাড়া রোগবালাইও কম হয়। তাই কৃষকদের নিয়মিত জমি পরিদর্শন করে পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
৮. জৈব প্রতিকার
রাসায়নিকের চেয়ে জৈব প্রতিকার পরিবেশ ও মানুষের জন্য নিরাপদ। নিম তেল, নিমপাতার রস, লঙ্কা ও রসুনের মিশ্রণ স্প্রে করলে অনেক পোকা দমন হয়। ট্রাইকোডার্মা, ফেরোমন ফাঁদ, স্টিকি ট্র্যাপ ইত্যাদি জৈব উপকরণ ব্যবহার করা যেতে পারে। এসব পদ্ধতি খরচ সাশ্রয়ী এবং গাছ দীর্ঘ সময় সুস্থ থাকে। এছাড়া ফল নিরাপদ থাকে এবং বাজারে ভালো দামে বিক্রি হয়।
৯. রাসায়নিক প্রতিকার
যখন পোকার আক্রমণ বেশি হয়ে যায় এবং জৈব প্রতিকার কাজ করে না, তখন অনুমোদিত কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। তবে সঠিক মাত্রা এবং সঠিক সময় মেনে ব্যবহার করা জরুরি। ফল সংগ্রহের অন্তত ১০–১২ দিন আগে স্প্রে বন্ধ করতে হবে, যাতে বিষ অবশিষ্ট না থাকে। কৃষি অফিসের পরামর্শ নিয়ে কীটনাশক ব্যবহার করা উচিত। এভাবে করলে ফল নিরাপদ থাকে এবং কৃষকও লাভবান হয়।
১০. সমন্বিত দমন ব্যবস্থা (IPM)
লাউ গাছের পোকা দমনে সবচেয়ে কার্যকর হলো সমন্বিত দমন ব্যবস্থা (IPM)। এতে জৈব, যান্ত্রিক, প্রাকৃতিক ও রাসায়নিক সব ধরনের পদ্ধতি একসাথে প্রয়োগ করা হয়। যেমন প্রথমে জমি পরিষ্কার রাখা, পরে ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার, প্রয়োজনে নিম তেল স্প্রে এবং শেষ ধাপে কীটনাশক প্রয়োগ। এতে খরচ কমে, পরিবেশ সুরক্ষিত থাকে এবং ফলও নিরাপদ হয়। IPM এখন বাংলাদেশে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে।
লাউ এর জাতের নাম?

বাংলাদেশে লাউ একটি অতি পরিচিত ও জনপ্রিয় সবজি। লাউ শুধু ঘরে রান্নায় নয়, বাজারে বিক্রির জন্যও একটি অর্থকরী ফসল। চাহিদার কারণে দেশে বারোমাস লাউ চাষ করা হয় এবং এজন্য বিভিন্ন জাতের লাউ উন্নত করা হয়েছে। প্রতিটি জাতের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে—
কোনটি আকারে বড়, কোনটি ছোট, কোনটি লম্বাটে আবার কোনটি ডিম্বাকার। কৃষকরা তাদের জমির অবস্থা, আবহাওয়া ও বাজারের চাহিদা অনুযায়ী লাউ এর জাত নির্বাচন করেন। নিচে বাংলাদেশে প্রচলিত ১০টি জনপ্রিয় লাউ এর জাত ও তাদের বিস্তারিত বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো।
১. বারোমাসি লাউ
বারোমাসি লাউ নামের মধ্যেই বোঝা যায় এটি সারা বছর চাষ করা সম্ভব। এই জাতের লাউ সাধারণত মাঝারি আকারের হয় এবং চাহিদা সারা বছর থাকায় কৃষকরা বেশি আগ্রহ দেখান।
এই জাতের গাছ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক বেশি, বিশেষ করে লাউ গাছের গোড়া পচা রোগের প্রতিকার হিসেবে অনেক কৃষক এ জাত বেছে নেন। এর ফল সাধারণত গোলাকার বা ডিম্বাকার হয়, খেতে নরম ও সুস্বাদু। বারোমাসি লাউ বাজারে ভালো দাম পাওয়া যায় কারণ অফ-সিজনেও চাহিদা থাকে।
২. স্থানীয় লম্বা লাউ
স্থানীয় লম্বা লাউ হলো বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী একটি জাত। এ জাতের ফল লম্বাটে আকারের হয় এবং দৈর্ঘ্যে ২ থেকে ৩ ফুট পর্যন্ত হয়। খেতে নরম, মিষ্টি স্বাদের এবং রাঁধতে কম সময় লাগে।
গ্রামাঞ্চলে গৃহস্থালী কাজে এ জাত বেশি জনপ্রিয়। বাজারে লম্বা লাউ দেখতে আকর্ষণীয় হওয়ায় ভালো দাম পাওয়া যায়। যদিও এই জাত রোগবালাইয়ের আক্রমণে কিছুটা সংবেদনশীল, তবে সঠিক যত্ন নিলে উৎপাদন ভালো হয়।
৩. স্থানীয় গোল লাউ
এটি আরেকটি জনপ্রিয় স্থানীয় জাত, যা আকারে গোলাকার বা হালকা ডিম্বাকার হয়। গৃহস্থালী রান্নায় গোল লাউ বিশেষভাবে জনপ্রিয় কারণ এটি সহজে টুকরা করে রান্না করা যায়। ফলের খোসা পাতলা, ভেতরের অংশ নরম এবং স্বাদে মিষ্টি। বাজারে ছোট পরিবারের জন্য গোল লাউ বেশি চাহিদাসম্পন্ন। যদিও ফলন মাঝারি, তবে স্বাদের কারণে এটি কৃষকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছে।
৪. অপূর্বা লাউ
অপূর্বা একটি উন্নত জাতের লাউ যা বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARC) উদ্ভাবন করেছে। এই জাতের গাছ রোগ প্রতিরোধী এবং দ্রুত ফল দেয়। এর ফল সাধারণত লম্বাটে, গায়ের রং হালকা সবুজ এবং মসৃণ খোসা যুক্ত। বাজারে এই জাতের চাহিদা সবসময় থাকে। কৃষকেরা বাণিজ্যিকভাবে চাষ করে ভালো লাভবান হন।
৫. ইপসা লাউ
ইপসা লাউ একটি উচ্চফলনশীল জাত যা গ্রামীণ কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয়। এ জাতের ফল সাধারণত আকারে বড় হয় এবং উৎপাদনও বেশি হয়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো থাকায় অনেক কৃষক লাউ গাছের গোড়া পচা রোগের প্রতিকার হিসেবে এই জাতকে অগ্রাধিকার দেন। ইপসা লাউ রান্নায় সুস্বাদু এবং দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়।
৬. শাহী লাউ
শাহী লাউ আকারে বড় ও ভারী হয়, যা বাজারে আকর্ষণীয় দামে বিক্রি হয়। এই জাত মূলত বাণিজ্যিক চাষের জন্য বেশি উপযোগী। ফলের খোসা মোটা এবং টেকসই, ফলে দূর দূরান্তে পরিবহনে সুবিধা হয়। কৃষকরা একে “লাভজনক জাত” হিসেবে দেখেন কারণ এর ফলন বেশি এবং বাজারে দামও ভালো পাওয়া যায়।
৭. আজিজ লাউ
আজিজ লাউ একটি উন্নত জাত যা বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলে বিশেষভাবে জনপ্রিয়। ফল মাঝারি আকারের হয় এবং খেতে বেশ নরম। গাছ সাধারণত কম রোগে আক্রান্ত হয় এবং দীর্ঘ সময় ফলন দেয়। ছোট ও বড় উভয় পরিবারের জন্য এ জাত উপযোগী।
৮. বারী লাউ-১
বারী লাউ-১ বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত একটি জাত। এর ফল লম্বাটে আকারের হয় এবং দৈর্ঘ্যে ১.৫ থেকে ২.৫ ফুট পর্যন্ত হয়। উৎপাদন ভালো হয় এবং বাজারে এর চাহিদা সবসময় থাকে। ফল সাধারণত সাদা-সবুজ রঙের এবং মসৃণ ত্বক বিশিষ্ট। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও ভালো।
৯. বারী লাউ-২
বারী লাউ-২ উন্নত মানের একটি জাত যা উচ্চ ফলন দেয়। এর ফল ডিম্বাকার হয় এবং আকারে মাঝারি থেকে বড়। কৃষকেরা বিশেষ করে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করে বেশি লাভবান হন। এ জাত লাউ গাছের গোড়া পচা রোগের প্রতিকার হিসেবে কার্যকর, কারণ এটি তুলনামূলকভাবে কম আক্রান্ত হয়। বাজারে এই জাতের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে।
১০. হাইব্রিড লাউ
বর্তমানে বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির হাইব্রিড লাউ এর জাত পাওয়া যায়। হাইব্রিড জাত সাধারণত উচ্চফলনশীল, দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং ফল আকারে বড় হয়। এ জাতগুলো বাজারের জন্য উপযোগী কারণ এর আকার ও রঙ আকর্ষণীয়। তবে হাইব্রিড জাতের বীজ প্রতি মৌসুমে কিনতে হয় এবং এটি কিছুটা ব্যয়বহুল। তবুও, উৎপাদনের দিক থেকে এটি কৃষকের জন্য লাভজনক।
বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর সমূহ
লাউ গাছের গোড়া পচা রোগের প্রতিকার এই বিষয়ে আপনার মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে? তাহলে চলুন জেনে নেই সেই সকল প্রশ্ন ও উত্তরগুলো-
লাউ গাছের গোড়া পচা রোগের প্রতিকার কীভাবে করা যায়?
লাউ গাছের গোড়া পচা রোগের প্রতিকার করতে হলে প্রথমেই মাটি ঝরঝরে রাখতে হবে এবং জমিতে অতিরিক্ত পানি জমতে দেওয়া যাবে না। আক্রান্ত গাছের গোড়ায় ট্রাইকোডার্মা বা কপার অক্সিক্লোরাইড ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধী জাত নির্বাচন এবং জমি পরিষ্কার রাখা খুবই জরুরি।
কোন জাতের লাউ চাষে রোগবালাই কম হয়?
বাংলাদেশে বারী লাউ-১, বারী লাউ-২, ইপসা লাউ এবং কিছু হাইব্রিড জাত তুলনামূলকভাবে রোগবালাই প্রতিরোধে ভালো। এসব জাত লাউ গাছের গোড়া পচা রোগের প্রতিকার হিসেবে কার্যকর কারণ গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। কৃষকেরা বাণিজ্যিক চাষে এসব জাত ব্যবহার করলে ভালো ফলন ও বাজারে বেশি দাম পান।
উপসংহার
বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থায় লাউ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সবজি ফসল। এটি শুধু পরিবারের খাদ্য তালিকায় নয়, বরং গ্রামীণ অর্থনীতিতেও বড় ভূমিকা রাখে। লাউ গাছ দেখতে সহজ হলেও এর যত্ন নেওয়া একটি শিল্পের মতো। বিশেষ করে লাউ গাছের গোড়া পচা রোগের প্রতিকার একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
কারণ এ রোগ একবার জমিতে দেখা দিলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং ফলন নষ্ট করে দেয়। তাই কৃষককে শুরু থেকেই সচেতন হতে হয়। জমির পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নত করা, রোগ প্রতিরোধী জাত নির্বাচন, জৈব সার ব্যবহার, এবং সময়মতো রোগ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেওয়া হলো এর সমাধানের মূল কৌশল।
লাউ গাছের সঠিক যত্ন নিলে সারা বছর চাষ করা সম্ভব। বারোমাসি লাউ চাষ পদ্ধতি কৃষকদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করেছে, কারণ এটি বছরের সব মৌসুমে ফলন দেয়। তবে এ ক্ষেত্রে সঠিক জাত নির্বাচন, মাটির মান উন্নয়ন, সেচ ব্যবস্থা, সার প্রয়োগ এবং রোগবালাই নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি। উন্নত প্রযুক্তি ও কৃষি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে চললে লাউ চাষ আরও লাভজনক হতে পারে।
বাংলাদেশে লাউ গাছের প্রধান সমস্যা হলো পোকামাকড় ও রোগবালাই। এদের মধ্যে ফল ছিদ্রকারী পোকা, এফিড, সাদা মাছি, লাল মাকড়সা ইত্যাদি প্রধান। তাই লাউ গাছের পোকা দমন নিয়ে কৃষকদের সচেতনতা থাকা দরকার। জৈব কীটনাশক ব্যবহার, নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, এবং প্রয়োজনে রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণই সমাধান। তবে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার না করাই ভালো, কারণ তা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
বাংলাদেশে লাউ এর বিভিন্ন জাত রয়েছে—স্থানীয়, উন্নত ও হাইব্রিড। প্রতিটি জাতের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও উপযোগিতা রয়েছে। যেমন, বারোমাসি লাউ সারা বছর ফল দেয়, স্থানীয় লম্বা ও গোল লাউ রান্নায় জনপ্রিয়, আর বারী লাউ ও হাইব্রিড জাত বাণিজ্যিকভাবে চাষ করে কৃষকেরা লাভবান হন। তাই চাষের উদ্দেশ্য অনুযায়ী জাত নির্বাচন করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
শেষ পর্যন্ত বলা যায়, লাউ চাষ বাংলাদেশের কৃষকের জন্য একটি লাভজনক ক্ষেত্র। তবে সঠিক যত্ন, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং রোগবালাই প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ফলন ও আয় দুটোই কমে যাবে। তাই কৃষককে সবসময় সতর্ক থাকতে হবে।
লাউ গাছের গোড়া পচা রোগের প্রতিকার, বারোমাসি চাষ পদ্ধতি, পোকা দমন, এবং উন্নত জাত নির্বাচন—এই চারটি দিকের উপর বিশেষ নজর দিলে লাউ চাষ থেকে ভালো ফলন ও লাভবান হওয়া সম্ভব। এভাবেই বাংলাদেশের কৃষি খাতে লাউ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এবং কৃষকের আর্থিক উন্নতিতে অবদান রাখবে।
